আজকের পোষ্টে আমরা কিছু ভেষজ খাবারের গুণাগুণ এবং ব্যবহার সম্পর্কে জানাব। তবে তার আগে চলুন একটি দৃশ্যকল্প দেখে নেই-
ঢাকা শহরে ছেলের বাসায় বেড়াতে এসেছেন
এমাজউদ্দিন সাহেব। দুটো নাতিকে দেখেছেন তাও বহুদিন হয়ে গেল। ঢাকায় তাই না
আসলেই নয়। ছেলের চাকরির ব্যস্থতার কারণে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময়
হয় না বললেই চলে। অগত্যা এমাজউদ্দিন সাহেবকে নিজেই চলে আসতে হল ঢাকায়! সাথে
এসেছেন তাঁর স্ত্রী রাহেলা খাতুন।
ছেলের ঢাকা শহরে নিজের বাসা, দুই নাতি
দেশের স্বনামধন্য এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ালেখা করে, এমাজউদ্দিন সাহেবের
সম্পদশালী ছেলে রাহাতের অবস্থানে সমাজের উপরতলাতেই – একথা বলা চলে। ছোটখাট
অসুখ বিসুখ সারাতে রাহাত পরিবার নিয়ে পাড়ি জমায় বিদেশ, চিকিৎসা করায়
বিদেশের দামী হাসপাতালে – ঢাকায় এসে এই জিনিসটা আবিষ্কার করতে পেরে বেশ
বিরক্ত হলেন এমাজউদ্দিন সাহেব। ঢাকায় আসার দ্বিতীয় দিনের মাথায় সকাল থেকে
ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ছোট নাতির প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগেছে, আগেরদিন স্কুল থেকে
বাসায় ফেরার সময় বৃষ্টিতে ভিজে এ দশা হয়েছে তার। বৌমার হুলস্থুল
চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে রুমের বাইরে এসেই এমাজউদ্দিন সাহেব দেখেন এই
অবস্থা! জোরে জোরে ফোনে কার সাথে জানি কথা বলছে বৌমা। কথা শেষ করে বৌমা
দেখলো এমাজউদ্দিন সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
– বাবা দেখেছেন কি যন্ত্রণায় পড়লাম?
রাতুলের ঠাণ্ডা লেগে জ্বর এসে বিতিকিচ্ছিরি এক ব্যাপার হয়েছে! “XYZ
হাসপাতাল” এর ডঃ আনসারির কাছ থেকে সিরিয়ালই পাওয়া যাচ্ছেনা আজকের মধ্যে! কি
একটা যন্ত্রণা দেখুন তো! ছেলেটার স্কুলে যাওয়া লেখাপড়া সব বন্ধ হয়ে যাবে
নাকি!
– মা, কি হয়েছে রাতুলের? ঠান্ডাজ্বর তাই তো? ডাক্তারের জন্য এত হুলস্থুল করছ কেন? দাওয়াই তো চাইলে হাতের কাছেই পাওয়া যায়!
– কি যে বলেন বাবা, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ খাওয়াটা কি ঠিক?
– তা হয়তো ঠিক না, কিন্তু এসব ঠাণ্ডা
জ্বরের মত এরকম অনেক রোগবালাইয়ের চিকিৎসা কিন্তু আমরা চাইলে ঘরে বসেই করতে
পারি! ডাক্তারের ওষুধের জন্য অপেক্ষা করতে হয়না! এই যে তোমরা কথায় কথায়
যেকোন অসুখ হলে বিদেশ যাও, এত খরচের কি দরকার যদি আমরা স্বাস্থ্যকর কিছু
খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আগে থেকেই রোগবালাইকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি?
– তা কি করে হয় বাবা?
– বলছি! কই রাহেলা কই গেলা? তুমিও আসো! আজ
তোমাদের ভেষজ গুণাগুণসম্পন্ন এমন কিছু খাবারের নাম বলব যা খেলে শরীর
এমনিতেই সুস্থ থাকবে! এভাবে বারবার বিভিন্ন অসুখে-বিসুখে ডাক্তারের
সিরিয়ালের জন্য ছুটাছুটি করা লাগবেনা!
ভেষজ খাবার এর উপকারিতা ও ব্যবহার
যষ্টিমধু
অন্যতম প্রধান একটি ভেষজ খাবার। এটা মূলত
গাছের শিকড়। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে, পৃথিবীতে যত ওষুধ তৈরি হয়, তার প্রায়
প্রতিটিতে যষ্টিমধু দেওয়া হয়। ঠাণ্ডা লাগা, ঠান্ডাজ্বর, কাশি, গলাব্যথা,
রক্তক্ষরণ বন্ধ করতেও যষ্টিমধুর তুলনা নেই। যাঁরা এসিডিটিতে ভোগেন, তাঁরা
ফুটানো পানিতে যষ্টিমধু ভিজিয়ে ঠাণ্ডা করে ওই পানির ভেতর মধু দিয়ে পান
করুন, উপকার পাবেন। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে দুধের সঙ্গে যষ্টিমধুর গুঁড়া মিশিয়ে
পান করুন, স্মৃতিশক্তি বাড়বে। ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ করতে যষ্টিমধু ও ঘি
একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করুন। এছাড়া ত্বকের বলিরেখা, ব্রণ ও দাগ দূর করে।
অশ্বগন্ধা
অশ্বগন্ধা এমন
একটি ভেষজ খাবার যা ক্লান্তি দূর করতে দারুণভাবে সাহায্য করে। আমাদের শরীর
যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পরে, তখন রোগ প্রতিরোধ সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে
বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই সময় অশ্বগন্ধা এন্ডোক্রাইন হরমোনের নিঃসরণে ভারসাম্য
বজায় রাখতে পারে এবং আমাদের স্নায়ুকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। এরফলে
ক্লান্তি খুব সহজে দূর হয়। এছাড়াও অশ্বগন্ধা আমাদের শরীরের ভিতর রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও সাহায্য করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে
অশ্বগন্ধা দুশ্চিন্তা, স্নায়ুরোগ সহ নানারকম রোগের প্রতিকার করার কাজে
ব্যবহৃত হত। যেহেতু অশ্বগন্ধা ক্লান্তি দূর করে স্নায়ুকে আরাম প্রদান করতে
পারে, তাই ঘুম আসে খুব তাড়াতাড়ি। এছাড়াও, খুব তাড়াতাড়ি চিন্তামুক্ত করে
নিশ্চিন্তে ঘুমোতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে,
অশ্বগন্ধা ব্যবহার করলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
ডায়াবেটিসের সমস্যা এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার। যদিও এই সমস্যাকে কাবু করতে
অশ্বগন্ধার জুড়ি মেলা ভার। প্রাচীনকালে অশ্বগন্ধার সঙ্গে অন্যান্য উপাদান
মিশিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হতো।
২০০৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে,
ভেষজ অশ্বগন্ধার সঙ্গে শিলাজিত মিশিয়ে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিক থাকে
এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ জীবন দান করতে পারে। অশ্বগন্ধা
বাতের সমস্যা প্রাকৃতিকভাবে সারাতে পারে। বাতের সমস্যায় এমন বহু ওষুধ আছে,
যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এদিকে অশ্বগন্ধা কোনও
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই বাতের সমস্যা সমাধান করতে পারে। এছাড়াও, হাঁটু
এবং কনুই ফুলে যাওয়া ও ব্যাথা দূর করতে অশ্বগন্ধার জুড়ি মেলা ভার।
অশ্বগন্ধা ত্বককে চিরনতুন এবং উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে। অশ্বগন্ধা
এস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। যা কোলাজেন তৈরি করে ত্বককে
উজ্জ্বল রাখে। এছাড়াও অশ্বগন্ধার শেকড় প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য
করে। অশ্বগন্ধা আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসাবে খুব ভাল স্নায়ুর সমস্যা দূর করতে
সাহায্য করে। এটি স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতেও সাহায্য করে। আসলে অশ্বগন্ধার
মধ্যে উপস্থিত শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন
করে থাকে।
চিরতা গুড়া
চিরতার গুড়া
স্বাদে তেতো, কিন্ত দারুণ উপকারি একটি ভেষজ খাবার। বিভিন্ন ধরনের রোগ
প্রতিরোধে চিরতা কার্যকর। ডায়রিয়া ও লিভারের বিভিন্ন রোগে প্রতিরোধে চিরতার
পানি উপকারী। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে ৫ থেকে ১০ গ্রাম চিরতা ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ
করে ২ কাপ করুন। এর পর ওই পানি ছেঁকে সকালে অর্ধেক এবং বিকালে অর্ধেক করে
পান করুন। অ্যালার্জিতে শরীর ফুলে উঠলে চিরতার পানি পান করলে উপকার পাবেন।
রাতে ৫ গ্রাম চিরতা ২৫০ মিলিলিটার গরম পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে
ওই পানি ২-৩ বার পান করুন। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে বমিভাব হলে ১ গ্রাম
চিরতা গুড়ো করে চিনির পানি মিশিয়ে পান করলে বমি বন্ধ হয়ে যাবে।
জ্বরের কারণে বারবার বমি হতে থাকলে সে
খেত্রে ২ কাপ গরম পানিতে ৫ গ্রাম চিরতা একটু থেঁতো করে ভিজিয়ে রাখুন।
দু-তিন ঘণ্টা পর ছেঁকে পানি অল্প অল্প করে পান করুন। হাঁপানির প্রকোপ বেশি
হলে আধা গ্রাম চিরতা গুড়া ৩ ঘণ্টা পর পর মধু মিশিয়ে ২ থেকে ৩ বার অল্প অল্প
করে চেটে খান। হাঁপানির প্রকোপ কমবে। কৃমির উপদ্রব হলে ২৫০ থেকে ৫০০
মিলিগ্রাম পর্যন্ত চিরতা অল্প মধু বা একটু চিনি মিশিয়ে খান, সমস্যা মিটবে। এ
ছাড়া কৃমির কারণে যদি পেটব্যথা হয়, তাও সেরে যাবে। চুল পড়ে যাওয়াও রোধ করা
যায় চিরতার মাধ্যমে। খুশকি থাকলে তাও সেরে যাবে চিরতার গুণে।
মেথি গুড়া
মেথি সবাই চেনেন। মেথিকে মসলা, পথ্য, খাবার – তিনটিই বলা যায়।
মেথি গুড়ার
স্বাদ খানিকটা তিতা। এতে রয়েছে রক্তের চিনির মাত্রা কমানোর বিস্ময়কর
শক্তি। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব উপকারী। মেথিতে রয়েছে তারূণ্য
ধরে রাখার আশ্চর্য এক ক্ষমতা। যারা নিয়মিত মেথি খান, তাদের বুড়িয়ে যাওয়ার
গতি অত্যন্ত ধীর হয়। লেবু ও মধুর সাথে এক চা-চামচ মেথি মিশিয়ে খেলে সর্দি
কাশি পালাবে। এছাড়া মেথিতে বিদ্যমান মিউকিল্যাগ গলাব্যথা সারাতে সাহায্য
করে। রক্তে চিনি কমানোর বিস্ময়কর উপাদান হিসেবে মেথি বিবেচিত হয়। সকালে
খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে অথবা মেথি ভেজানো পানি খেলে রক্তে ক্ষতিকর
কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে কৃমি ও
নানান রোগ দূর হয়। খাবারে মেথির স্বাস্থ্যসম্মত উপস্থিতি ডায়াবেটিক ও
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। মেথি গ্যাস্ট্রিক ও বদহজমের মহৌষধ হিসেবে পরিচিত।
মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য কালিজিরার মতো মেথি পিষে খেলে উপকার হয়। তবে মেথি
ভাজলে এর গুণাগুণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই কড়া রোদে মেথি শুকিয়ে তার
ভর্তা খাওয়া যেতে পারে। মাসিকের ব্যথায় কাঁচা মেথি চিবিয়ে খেলে উপকার
পাওয়া যায়। রূপচর্চাতেও মেথির ব্যবহার রয়েছে ব্যাপক। যেমন – মেথি নারকেল
তেলের বোতলে রেখে দিন। মেথি ভেজা এই তেল নিয়মিত ব্যবহারে চুলের গোড়া হয়
শক্ত ও মজবুত। মেথি গুঁড়ো টক দইয়ের সাথে মিশিয়ে চুলে লাগালে চুল হয়
কোমল ও ঝরঝরে। মেথি ভিজিয়ে তা বেটে মেহেদি ও ডিমের সাথে মিশিয়ে চুলে
লাগিয়ে আধ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। চুল পড়া রোধ হবে। মেথি
গরমজনিত ত্বকের অসুখে অত্যন্ত উপকারী। ত্বকে ঘা, ফোড়া, ইরিটেশন ইত্যাদি
দূরীকরণে মেথির জুড়ি নেই। মেছতায় মেথি বাটা নিয়মিত ব্যবহার করলে তা সহজে
ছড়িয়ে পড়ে না এবং ধীরে ধীরে কমে যায়। কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
থাকে।
ত্রিফলা গুড়া
ত্রিফলাকে বলা হয় “মাদার অফ অল হার্বস”। আমলকী, হরিতকি ও বহেরার সমানুপাতিক মিশ্রণে তৈরি
ত্রিফলা গুড়া।
এতে কোন চিনি যোগ না করায় এর স্বাদ হালকা ঝাঁজালো হবে। হাই কোলেস্টেরল
লেভেল আর আরথাইটিসের ঝুঁকি কমায়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হজম প্রক্রিয়া
ত্বরান্বিত করে ও বদহজম জনিত সমস্যা দূর করে। শরীরে ফ্যাট সেল জমতে না দিয়ে
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অন্ত্রের সব বর্জ্য দূর করে খাবার থেকে
পুষ্টি গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়ায়।
—–
বুঝতেই পারছেন যে খাদ্যদ্রব্য শুধুমাত্র
ক্ষুধা নিবারনের জন্যেই ব্যবহার হয়না। কিছু ভেষজ ধাদ্যদ্রব্য ওষুধ হিসেবেও
কাজ করে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই ভেষজ গুণসম্পন্ন খাদ্য গুলো সম্পর্কে
জানা এবং বিভিন্ন রোগ বালাই এড়াতে নিয়মিত খাওয়া।কিন্তু কোথায় পাবেন এসব
খাবার? চিন্তার কোন কারণ নেই। প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে দারুন সমাধান। অনলাইনে
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যদ্রব্য অর্ডার করার জন্য ভিজিট করুন